আবারও ক্ষমতায় এরদোয়ান, কেমন হবে আগামীর তুরস্ক

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী কামাল কিলিচদারোগলুকে দ্বিতীয় দফার ভোটে হারিয়ে আরও পাঁচ বছরের জন্য তুরস্কের প্রেসিডেন্ট থেকে গেলেন রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। শনিবার (৩ জুন) বিশ্বের বহু দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের উপস্থিতিতে তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন তিনি।

গত রোববার (২৮ মে) তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দ্বিতীয় দফার ভোটে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ৫২.১৪ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। অন্যদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী কামাল কিলিচদারোগলু পেয়েছেন ৪৭.৮৬ শতাংশ ভোট।

গত ১৪ মে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এবং পার্লামেন্ট নির্বাচনের ভোট হয়। প্রথম দফায় প্রেসিডেন্ট পদে কোনো প্রার্থী এককভাবে ৫০ শতাংশ ভোট নিশ্চিত করতে না পারায় নতুন করে এ ভোট নেয়া হয়।
 
১৯৯৪ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ইস্তাম্বুলের মেয়র ছিলেন এরদোয়ান। ২০০৩ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ছিলেন তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী। এরপর ২০১৪ সাল থেকে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট হিসেবে টানা দায়িত্ব পালন করে আসছেন তিনি।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, তুরস্কের অর্থনীতি যখন খারাপের দিকে, মূল্যস্ফীতি যখন বেড়েই চলেছে এবং অর্থনীতি শিগগিরই ভালো হবে বলে মনে হচ্ছে না, সেই মুহূর্তে বেশির ভাগ তুর্কি নাগরিক এরদোয়ানকে ভোট দিয়ে টানা তৃতীয়বার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত করলেন।
 
অনেকের মনে প্রশ্ন, এরদোয়ান কীভাবে এই নির্বাচনে জিতলেন এবং অদূর ভবিষ্যতে দেশটির কপালে কী ঘটতে যাচ্ছে ?
 
নির্বাচন অবাধ হলেও স্বচ্ছতার অভাব ছিল
তুরস্কের নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো স্বাধীনভাবে প্রার্থী দিতে পেরেছে, সভা-সমাবেশও অবাধে করতে পেরেছে। ভোট যাতে সঠিকভাবে গণনা করা যায় তার জন্য প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে সব দলেরই নিজস্ব প্রতিনিধি থাকতে পেরেছেন।
 
ভোটাররাও স্বাধীনভাবে তাদের ভোট দিতে পেরেছেন। তারপরও এই নির্বাচনে স্বচ্ছতার অভাব ছিল। কারণটি হলো-নির্বাচনে প্রথম সারির প্রতিদ্বন্দ্বীদের একজন একরেম ইমামোলুকে ‘সরকারি লোকদের অপমান করার’ অপরাধে গত ডিসেম্বরে দুই বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়।
 
ইমামোলু ২০১৯ সালে এরদোয়ানের সমর্থিত প্রার্থীকে হারিয়ে ইস্তাম্বুলের মেয়র হয়েছিলেন। জরিপে দেখা গেছে, ইমামোলু আইনি ঝামেলামুক্ত থাকলে ভালোভাবেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এরদোয়ানকে হারাতে পারতেন।  অনেকে বলছেন, ইমামোলুকে দৃশ্যপট থেকে দূরে রাখতেই আদালত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে এ কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছেন।
আরেকটি বিষয় হলো-তুর্কি গণমাধ্যমে এরদোয়ানের মুঠোর মধ্যে থাকায় তিনি নির্বাচনী প্রচারে সর্বোচ্চ সুযোগ পেয়েছেন। যে প্রক্রিয়ায় নির্বাচনের ফল ঘোষণা হয়েছে, তাতে যথেষ্ট অস্বচ্ছতা ছিল। ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার পর ব্যালট ও রেজাল্ট শিট পুলিশ অথবা সেনাবাহিনীর সদস্যরা নির্বাচন কমিশনের কাছে পাঠিয়েছে।
 
এখানেই মূল সন্দেহের বিষয়, কারণ পুলিশ এবং সেনাবাহিনী দুটোই এরদোয়ানের নিয়ন্ত্রণে আছে। এরপর নির্বাচন কমিশন শুধু রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা আনাদোলু এজেন্সির মাধ্যমে সেই ফল ঘোষণা করেছে, অথচ এর আগে স্বতন্ত্র সংবাদমাধ্যমগুলো ফল ঘোষণা করতে পারতো।
 
ধর্মীয় ভোটারদের দৃঢ় সমর্থন
এরদোয়ানের জেতার পেছনে ধর্মীয় অনুভূতিসংশ্লিষ্ট দুটো বড় কারণ আছে। প্রথমটি হলো প্রথম রাউন্ডের নির্বাচনে ৫.২ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয় অবস্থানে থাকা সিনান ওগানের সমর্থন পেয়েছেন এরদোয়ান। ওগানকে সমর্থন দিতে এরদোয়ান প্রথম থেকেই অনুরোধ করে আসছিলেন।
 
দ্বিতীয়টি হলো রক্ষণশীল ও ধর্মভিত্তিক দক্ষিণপন্থি দলগুলো এরদোয়ানকে ইসলাম ও তুর্কি জাতির বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে বসে চক্রান্ত করা লোকদের মোকাবিলা করতে সক্ষম একজন বিশ্বনেতা মনে করেন। এই ভোটাররা ধর্মীয় দায়িত্ব মনে করে এরদোয়ানকে ভোট দিয়েছেন। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে তুরস্কের ধর্মীয় জনগোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে নিপীড়নের শিকার হয়েছে।
 
কেমন যাবে সামনের দিনগুলো
মুক্ত নিশ্বাস নেয়ার জন্য তুরস্কবাসীর জন্য একটি রাজনৈতিক পরিবর্তন দরকার। কেননা দেশটির সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা আরও খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এরদোয়ান অঙ্গীকার করেছিলেন, নতুন তুরস্ক প্রতিষ্ঠার শততম বর্ষে (২০২৩ সালের মধ্যে) তিনি তুরস্ককে পাল্টে দেবেন। তুরস্ক ২০২৩ সালে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর ১০টির মধ্যে একটি থাকার কথা ছিল। তবে বাস্তবতা হলো, দেশটি এখন সবচেয়ে ধনী দেশের ২০টির মধ্যে ১৯ নম্বরে রয়েছে।
 
গত তিন বছরে তুরস্কের অর্থনীতি ক্রমাগত নিচের দিকে নামছে। লিরা ডলারের বিপরীতে মূল্য হারাচ্ছে। গত কয়েক মাসে নির্বাচনের ব্যয় মেটাতে রিজার্ভ খালি করে ফেলেছে তুর্কি কেন্দ্রীয় ব্যাংক, তুরস্কের জনগণের জন্য যা বয়ে আনতে পারে ‘ব্যাপক বেকারত্ব ও জীবনযাত্রার ব্যয় সংকোচন’। তুরস্কে মুদ্রাস্ফীতির হার গত ২৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
 
এরদোয়ানকে এখন দেশটির অর্থনৈতিক খাতের দিকে বেশি মনযোগ দিতে হবে। তিনি হয়তো উচ্চ-সুদে বিদেশী ঋণের আশ্রয় নেবেন এবং তেল সমৃদ্ধ মুসলিম দেশগুলোকে তাদের তহবিলের কিছু অংশ তুরস্কে বিনিয়োগ করার জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করবেন। এই প্রচেষ্টা কতটা সফল হবে এবং স্বল্পমেয়াদী এসব উদ্যোগ তুরস্কের অর্থনীতিতে কতটা অবদান রাখেতে পারে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।
 
পররাষ্ট্র নীতিতে এরদোয়ান উত্তর আটলান্টিক নিরাপত্তা জোট বা ন্যাটো, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে স্বতন্ত্র একটি আঞ্চলিক শক্তিশালী রাষ্ট্র হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। সম্ভবত তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক জোরদার করতে পারেন, যা তুরস্কের পশ্চিমা মিত্রদের জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে।
 
কী হতে পারে ভবিষ্যতে
তুরস্কের সংবিধান অনুসারে প্রেসিডেন্ট হিসেবে এটিই হয়তো এরদোয়ানের শেষ কার্যকাল। বর্তমান অবস্থায় এরদোয়ান অর্থনীতির গতি ফেরাতে পারবেন কিনা, তা নিয়ে সংশয় আছে। ৬৯ বয়সী এরদোয়ান নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। তিনি স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারেন না। হয়ত মেয়াদ শেষের আগেই তাকে তার ডেপুটির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। ফলে তুরস্কের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ এখনও অনিশ্চিতই থেকে যাচ্ছে।
 
আরেকটি বিষয় হলো এমন আশঙ্কাও আছে যে, মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই এরদোয়ানকে ক্ষমতাচ্যুত করার চিন্তা থেকে তার বিরুদ্ধে ‘দলীয় অভ্যুত্থান’ ঘটতে পারে। এই দাবির পক্ষে যুক্তি হলো, এরদোয়ানের নিজের দলের মধ্য থেকেই কোনো কোনো নেতা অভ্যুত্থান ডেকে আনতে পারেন এই উদ্দেশ্য থেকে যে, এর ফলে ২০২৮ সালের নির্বাচনের আগে নিজের পক্ষে জনসমর্থন গড়ে তোলা সহজ হবে।
নির্বাচন-পরবর্তী তুরস্কে আপাতত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকতে পারে, তবে অদূর ভবিষ্যতে দেশটি অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে পরতে পারে বলে বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *