আন্তর্জাতিক ডেস্ক: রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম বেড়ে গিয়েছিল। আকাশ ছুঁয়েছিল তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি), ক্রুড অয়েল ও কয়লার দাম।
তবে গত কয়েক মাস ধরে কমতে কমতে এখন তা প্রায় যুদ্ধ-পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে এগুলোর সরবরাহও পর্যাপ্ত। যা বিশ্বের অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য অনেকটাই স্বস্তি নিয়ে এসেছে।
তবে সেই স্বস্তি সম্ভবত খুব বেশিদিন থাকছে না। তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোর বিশেষ করে রাশিয়া ও সৌদি আরবের মধ্যে একটা নীরব রেষারেষি চলছে। দেশ দুটির এই দ্বন্দ্বের ফলে বৈশ্বিক তেলবাজার শিগগিরই অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। সাত বছর পর প্রথমবারের মতো ব্যারেলপ্রতি ক্রুড অয়েলের দাম পৌঁছেছিল ১২০ ডলারে। আর তরলিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজির দাম পৌঁছেছিল প্রতি এমএম বিটিইউ সর্বোচ্চ ৭০ ডলারে।
তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার আশঙ্কা তৈরি হয়। ফলে তেলের দাম আবারও কমতে শুরু করে। যে ক্রুড অয়েলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১২০ ডলারে পৌঁছেছিল, তা এখন ৭০ ডলার। আর যে এলএনজির দাম পৌঁছেছিল প্রতি এমএম বিটিইউ সর্বোচ্চ ৭০ ডলারে, তা এখন ১৩-১৪ ডলার।
স্বল্পমূল্যের রুশ জ্বালানি তেলে বিশ্ববাজার সয়লাব, সৌদির ক্ষোভ
বিশ্বে যত বেশি তেল উৎপাদন হবে, ততই কমবে এর দাম। কিন্তু বিশ্বের শীর্ষ তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো বেশি দামে তেল বিক্রি করতে চায়। এজন্য তেল রফতানিতে শীর্ষ দেশগুলোর সংগঠন ওপেকের মধ্যে একটি চুক্তি রয়েছে।
যার মোদ্দাকথা, তেলের উৎপাদন কমিয়ে দরপতন ঠেকানো ও দাম সমুন্নত রাখা। সেই চুক্তি অনুযায়ী গত কয়েক বছর ধরেই দফায় দফায় তেলের উৎপাদন হ্রাস করেছে দেশগুলো।
সবশেষ চলতি বছরের এপ্রিল মাসে দিনে ২০ লাখ ব্যারেল বাধ্যতামূলক ও ১৬ লাখ ব্যারেল তেল স্বতঃপ্রবৃত্তভাবে হ্রাসের সিদ্ধান্ত নেয় ওপেক ও সহযোগী দেশগুলো। অর্থাৎ প্রত্যেক সদস্য দেশ বাধ্যতামূলক ২০ লাখ ব্যারেল; পাশাপাশি চাইলে দিনে আরও ১৬ লাখ ব্যারেল উৎপাদন হ্রাস করতে পারে।
কিন্তু চুক্তি মেনে উৎপাদন কমায়নি রাশিয়া। বিপরীতে বিশ্ববাজারে স্বল্পমূল্যে তেল বিক্রি করছে দেশটি। তাদের এই সস্তা তেলে বিশ্ববাজার রীতিমতো সয়লাব। এতে বিশেষ করে বিশ্বের অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। কিন্তু এতে মস্কোর ওপর ক্ষুব্ধ সৌদি আরব। কারণ তেলের দাম কমে যাওয়ায় তাদের আয় কমে গেছে।
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর গতমাসে রাশিয়ার জ্বালানি তেলের রফতানি সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি জানিয়েছে, এপ্রিল মাসে তেল রফতানি থেকে দেশটি অতিরিক্ত ১৭০ কোটি ডলার আয় করেছে। এএফপি জানিয়েছে, পশ্চিমা দেশগুলোর বিধিনিষেধ আরোপ সত্ত্বেও রাশিয়ার তেল রফতানি বাড়ছে।
প্যারিসভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির তথ্য বলছে, গতমাসে রাশিয়ার তেল রফতানি প্রতিদিন ৫০ হাজার ব্যারেল বেড়ে ৮৩ লাখ ব্যারেলে পৌঁছেছে। তাদের ধারণা, মস্কো তেলের উৎপাদন কমায়নি। ‘বরং রাশিয়া সম্ভবত উৎপাদন বাড়িয়ে তাদের রাজস্ব ক্ষতি পুষিয়ে নিচ্ছে,’ এক বিবৃতিতে বলেছে সংস্থাটি।
সৌদির উত্তোলন কমানোর সিদ্ধান্ত, বাড়ছে তেলের দাম
রাশিয়ার ওপর ক্ষোভ থেকে তেল উৎপাদন কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ জ্বালানি তেল উৎপাদনকারী দেশ সৌদি আরব। খবরে বলা হয়েছে, আগামী জুলাই থেকে জ্বালানি তেল উত্তোলন কমাবে দেশটি। সৌদি কর্তৃপক্ষের এ সিদ্ধান্তের পর এরই মধ্যে বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়তে শুরু করেছে।
ব্লুমবার্গের প্রতিবেদন মতে, প্রতিদিনের নিয়মিত পরিমাণের চেয়ে ১০ লাখ ব্যারেল কম জ্বালানি তেল উত্তোলন করবে সৌদি আরব। অপরিশোধিত তেলের মূল্য জটিলতা মীমাংসায় শীর্ষ তেল উৎপাদক ও রফতানিকারকদের জোট ওপেক প্লাসের সিদ্ধান্তেই তেল উত্তোলন কমাচ্ছে সৌদি। তবে এর কারণে বিশ্বজুড়ে বেড়ে যাচ্ছে জ্বালানি তেলের দাম।
রোববার (৪ জুন) সৌদি আরবের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সংবাদ সংস্থা সৌদি প্রেস এজেন্সি (এসপিএ) জানায়, দেশটি প্রতিদিন ১০ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদন কমিয়ে দেবে। এ খবর ছড়িয়ে পড়তেই লাগামছাড়া হয়ে উঠছে জ্বালানি তেলের দাম।
সোমবার (৫ জুন) সকালে আন্তর্জাতিক বাজার আদর্শ ব্রেন্টের দাম ১ শতাংশ বেড়ে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেল ৭৬ ডলার ৯ সেন্টে বিক্রি হয়েছে। অন্যদিকে মার্কিন বাজার আদর্শ ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েটের (ডব্লিউটিআই) দাম ১ দশমিক ২ শতাংশ বেড়ে ব্যারেলপ্রতি ৭২ ডলার ৬ সেন্টে দাঁড়িয়েছে।
রয়টার্সের প্রতিবেদন মতে, গত রোববার ভিয়েনায় শীর্ষ তেল উৎপাদক ও রফতানিকারকদের জোট ওপেক প্লাসের বৈঠকের পর সৌদি আরব এ সিদ্ধান্তের কথা জানায়। ওই বৈঠকে রিয়াদ ২০২৪ সাল নাগাদ প্রতিদিন ৫ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদন কমিয়ে দেয়ার বিষয়েও সম্মত হয়। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জোটের অন্যান্য দেশও আগামী বছরের শেষ পর্যন্ত তেল উত্তোলন কমিয়ে রাখবে।
তেলের দাম বৃদ্ধি অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে
তেল উৎপাদনকারীদের জোট ওপেকের সদস্য ও এর সহযোগী দেশগুলো বিশ্বের অপরিশোধিত তেলের ৪০ শতাংশ জোগান দেয়। ফলে তারা কোনো নীতিগত সিদ্ধান্ত নিলে বাজারে তার প্রভাব পড়ে।
পশ্চিমা দেশগুলো এরইমধ্যে অভিযোগ করেছে, ওপেক ও সহযোগী দেশগুলো কারসাজি করে তেলের দাম বাড়াচ্ছে এবং জ্বালানির দাম বাড়িয়ে বিশ্ব অর্থনীতির মূলে কুঠারাঘাত করছে।
এদিকে ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি (আইইএ) আশা করছে, ২০২৩ সালের দ্বিতীয় ভাগে বিশ্ববাজারে তেলের চাহিদা বাড়বে এবং তাতে তেলের দামও বাড়বে। যা নতুন করে ভোগবে বিশ্বকে।