মো: আবুল হাশেম:বাংলাদেশের কিংবদন্তি ব্যাংকার, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর, সোনালী ব্যাংক ও অগ্রনী ব্যাংককের সাবেক এমডি, বিশ্ববিদ্যালয় কর্মসংস্থান প্রকল্প (বিকল্প)-এর প্রতিষ্ঠাতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স আ্যন্ড ব্যাংকিং বিভাগের খন্ডকালীন শিক্ষক, বাংলাদেশের অতুলনীয়, অদ্বিতীয় গণমানুষের ব্যাংকার, বহু পুরস্কার সহ আদমজী পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক, জাতীয় কবিতা পরিষদের প্রতিষ্ঠাকালীন সহ-সভাপতি, বৃহত্তর বগুড়া সমিতি’র সাবেক সভাপতি ও সাচ্চা দেশপ্রেমিক লুৎফর রহমান সরকারের আজ ১০ম মৃত্যুবার্ষিকী।
লুৎফর রহমান সরকার ১৯৩৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার আমরুল ইউনিয়নের ফুলকোট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
আমার দেখা বাংলাদেশের সবচেয়ে সাহসী, প্রগতিশীল, গণমুখী, সৃজনশীল, উদ্ভাবনী শক্তি সম্পন্ন, সৎ, মহৎ, মানবদরদী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালনকারী, দেশ প্রেমিক ব্যাংকার লুৎফর রহমান সরকার। তাঁর মতন উদার, উন্নত চিন্তাচেতনা-মনমানসিকতা, হৃদয়বান, পরোপকারী মানুষ আমি জীবনে খুব কম দেখেছি। যে মানুষটি সবসময় দেশ, মাটি, মানুষের কল্যাণের কথা ভাবতেন। দেশ ও জনগণের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি তথা জীবন মানের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি অর্জন নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। যিনি নিজের বা পরিবারের কথা কখনোই ভাবতেন না। সারাক্ষণই দেশ আর জনগণ তাঁর চিন্তাচেতনা আচ্ছন্ন করে রাখত। আমার মনে হয় না আর কোনো ব্যাংকার তাঁর মতন দেশের ব্যাংকিক সেক্টরের আমূল পরিবর্তন এবং জনদায়বদ্ধতার কথা ভাবতেন বা ভাবেন।
তিনি বলতেন, এদেশের ব্যাংকিং সিস্টেম হচ্ছে তেলে মাথায় তেল দেয়া। যার আছে তাঁকে আরও দাও! কিন্তু ব্যাংকিং হওয়া উচিত যার নাই তাঁকে দেয়া। ব্যাংকের কাজ ধনীকে আরও ধনী বানানো নয়। গরীবকে ধনী বানানো। ব্যাংকের কাজ শুধু ব্যবসা করা নয়, দেশ এবং মানুষের সেবা করা। দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ, সচল, সজীব, চাঙ্গা রাখার পাশাপাশি কর্মসংস্থান, বেকারত্ব দূরসহ বিভিন্ন সমাজকল্যাণ ও উন্নয়নমূলক কাজে বিরতিহীনভাবে অংশ গ্রহণ করা।”
শুধু কথায় নয় কাজে পরিণত করে দেখিয়েছেন, সোনালী ব্যাংকের এমডি থাকাকালে- সমাজে শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং বেকারত্ব দূর করার লক্ষ্যে “বিশ্ববিদ্যালয় কর্মসংস্থান প্রকল্প (বিকল্প) প্রতিষ্ঠা করে। খন্ডকালিন চাকরি ও শিক্ষা ঋণ প্রকল্প চালু করে। আজ বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে যেসব সঞ্চয়ী ও জনকল্যাণমুখী স্কীম চালু আছে তার অধিকাংশ লুৎফর রহমান সরকার উদ্ভাবিত ও প্রবর্তিত। সোনালী ব্যাংকের এমডি থাকাকালিন, বিকল্পের মাধ্যমে উচ্চ শিক্ষিত বেকার ছাত্রদের শুধুমাত্র এমএ’র সার্টিফিকেট জমা নিয়ে ব্যাংক ঋণ দিয়ে বিভিন্ন ব্যবসাবানিজ্য ও শিল্প উদ্যোক্ত তৈরি করে ভীষণ সাড়া ফেলেছিলেন সমাজ-রাষ্ট্রে।
জনপ্রিয় সেই প্রকল্পগুলো কুক্ষিগত করে স্বনামে ঘোষণা করার স্বৈরশাসক এরশাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় তাঁকে এবং তাঁর সহকারী দেশের আরেক খ্যাতিমান ব্যাংকার সোনালী ব্যাংকের তৎকালিন জিএম ও পরবর্তীকালে এমডি (এবং অন্যান্য আরও কয়েকটি ব্যাংকের এমডি ও চেয়ারম্যান হয়েছিলেন) একিউ সিদ্দিকী, ডিজিএম আব্দুল কাইয়ুম, এজিএম রফিক উল্লাহকে এরশাদ গ্রেফতার করে (এসপিও সোলায়মানসহ কয়েকজনকে চাকরিচ্যুত করে) সামরিক আদালতে বিচার করে দু’বছরের কারাদণ্ড দেয়। আন্দোলনের মাধ্যমে ছাত্রজনতা তাঁদের মুক্ত করে নিয়ে আসে।
লুৎফর রহমান সরকারই বাংলাদেশের একমাত্র ব্যাংকার যিনি এরশাদ অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করলে দৈনিক সংবাদপত্রে সাক্ষাৎকার দিয়ে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে কথা বলেন। তিনিই বাংলাদেশের একমাত্র ব্যাংকার যিনি দেশের অত্যন্ত ক্ষমতাশালী ব্যবসায়ী ও শিল্পপতির বিরুদ্ধে ভূয়া আ্যকাউন্ট ও ভূয়া দলিলের মাধ্যমে ব্যাংকের কোটি কোটি টাকা মেরে দেয়ার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। হিংস্র, ক্রুদ্ধ সেই ঘৃণিত ব্যবসায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণরের চেম্বারে তাঁকে আক্রমণ করতে উদ্যত হয়!
তিনিই দেশে প্রথম ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জামানতবিহীন ক্ষুদ্র ব্যাংক ঋণ চালু করেন যা আজ এসএমই লোন হিসেবে পরিচিত। তিনিই দেশের ব্যবসা ও শিল্প-বানিজ্যে শিক্ষিত শ্রেণির নেতৃত্ব তৈরির উদ্যোগ নেন।তিনিই গরীব মেধাবী ছাত্ররা যেন শিক্ষা জীবন থেকে ঝরে না যায় সে জন্য “শিক্ষাঋণ প্রকল্প” চালু করেন। তিনিই দেশের শিল্প-সাহিত্যকে উন্নত ও বিকশিত করতে অকাতরে পৃষ্ঠপোষকতা দিতেন পত্রপত্রিকা, লিটলম্যাগাজিন,সাহিত্য-সংস্কৃতি -সামাজিক সংগঠনকে অকৃপণভাবে বিজ্ঞাপন দিয়ে।
প্রকাশনা শিল্পকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নত করতে সৃজনশীল প্রকাশকদের ডেকে এনে স্বল্পসুদে, জামানতবিহীন ব্যাংক ঋণ দিতেন। দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আধুনিক ও যুগোপযোগী করে তুলতে তিনিই ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় ডাক্তারদের সহজ শর্তে ঋণ দেন। বর্তমান বাংলাদেশের খ্যাতিমান অনেক ডাক্তার এবং হাসপাতাল তাঁরই অবদানে প্রতিষ্ঠিত ও স্বনামধন্য। দেশের বহু বিরাট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান লুৎফর রহমান সরকারের সহযোগিতায় আজকের অবস্থানে অবস্থিত।
এমনি নানা সৃজনশীল, যুগান্তকারী উদ্যোগ গ্রহণ করে তিনি দেশের ব্যাংকিংকে ধারা কে আমূল বদলে দেয়ার চেষ্টা করেন। চেষ্টা করেন মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের। যে কারণে একমাত্র লুৎফর রহমান সরকারকেই বাংলাদেশের “বিপ্লবী ব্যাংকার” বলা যায়।
লুৎফর রহমান সরকার ১৯৫৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পাস করেন। রেডিও পাকিস্তান দিয়ে কর্মজীবন শুরু করলেও পরে তিনি যোগ দেন করাচির হাবিব ব্যাংকে। এরপর ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট। ১৯৭২ সালে রূপালী ব্যাংকের উপমহাব্যবস্থাপক হন। ১৯৭৬ সালে অগ্রণী ব্যাংকে মহাব্যবস্থাপক হিসেবে যোগ দিয়ে পরে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে পদোন্নতি পান। ১৯৮৩ সালে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক হন। এরপর তিনি ১৯৯৬ সালের ২১ নভেম্বর থেকে ১৯৯৮ সালের ২১ নভেম্বর পর্যন্ত ষষ্ঠ গভর্নর হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া লুৎফর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগে দীর্ঘদিন খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেন।
২০১৩ সালের ২৪ জুন ঢাকার এ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর।
ক্ষণজন্মা এই মহান মানুষটি আজ ১০ম মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধার্ঘ্য ও অতল ভালোবাসা।
কবি মোহন রায়হান এর লেখা থেকে।