গতকাল ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখ সকাল ১০:৩০ মিনিটে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের সভাকক্ষে (১ কারওয়ান বাজার, টিসিবি ভবন-৮ম তলা, ঢাকা) সরকার নির্ধারিত মূল্যে আলু, পেঁয়াজ ও ডিম বিক্রয় নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সুপারশপ, পাইকারি বিক্রেতা ও বাজার কমিটির সংশ্লিষ্টদের অংশগ্রহণে মতবিনিময় সভা আয়োজন করা হয়।
বর্ণিত সভায় সভাপতিত্ব করেন জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) *জনাব এ.এইচ.এম. সফিকুজ্জামান।*
সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক ও সহকারী পরিচালকবৃন্দ, বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশনের উপ-প্রধান জনাব মো: মাহমুদুল হাসান, এনএসআই এর প্রতিনিধি, স্বপ্ন, মীনা বাজার, প্রিন্স বাজার, ডেইলী শপিং, আগোরা, আমানা বিগ বাজারের প্রতিনিধি এবং কারওয়ান বাজার, টাউনহল বাজার, এজিবি কলোনী বাজার, শ্যামবাজার ব্যবসায়ী সমিতির নেতৃবৃন্দ।
সভার শুরুতেই অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বর্ণিত সচেতনতামূলক সভার প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। এক্ষেত্রে তিনি বলেন, ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ ও ভোক্তা-অধিকার বিরোধী কার্য প্রতিরোধের লক্ষ্যে অধিদপ্তর নিয়মিত বাজার অভিযান পরিচালনা ও অভিযোগ নিষ্পত্তির মাধ্যমে নকল ও ভেজালের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। ভোক্তাবৃন্দ কোন পণ্য বা সেবা ক্রয় করে প্রতারিত হলে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ দায়ের করে থাকেন। তিনি বলেন, জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর কর্তৃক ভোক্তা অধিকার বিরোধী কার্যক্রম প্রতিরোধে নিয়মিত বাজার তদারকি/অভিযান করা হয়ে থাকে।
তিনি সভায় বলেন, অত্যাবশকীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৫৬ এর আওতায় বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশক্রমে সরকার চিনি ও ভোজ্য তেলের মূল্য নির্ধারণ করে থাকে। কৃষি পণ্যের ক্ষেত্রে কৃষি বিপণন আইনে উৎপাদক, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে কে কতটুকু লাভ করবে তার উল্লেখ আছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সুপারিশক্রমে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আলু-পেঁয়াজের দর নির্ধারণ করেছে।
আলোচনায় মহাপরিচালক বলেন, গত ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখ বাণিজ্যমন্ত্রী কর্তৃক আলু, পিঁয়াজ ও ডিমের মূল্য ঘোষণা করা হয়। এর আগে থেকেই অধিদপ্তর কর্তৃক দেশব্যাপী এসকল পণ্যের বাজার তদারকি শুরু করা হয়। মূল্য ঘোষণার পর অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত বাজার তদারকিতে ডিম নির্ধারিত মূল্যে বিক্রয় হতে দেখা গেলেও আলু, পিঁয়াজের ক্ষেত্রে অনিয়ম পাওয়া যায়। গত ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখ মুন্সীগঞ্জে, ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখ পর্যন্ত বগুড়া, রংপুর ও নীলফামারীতে মহাপরিচালক কর্তৃক জেলার হিমাগারসমূহ তদারকি করা হয় এবং জেলা প্রশাসন, গোয়েন্দা সংস্থা, সংশ্লিষ্ট দপ্তর/ সংস্থার কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে ব্যবসায়ীদের সাথে মতবিনিয় সভা করা হয়।
তিনি বলেন, মতবিনিময় সভা ও অধিদপ্তরের তদারকিতে এটি স্পষ্ট হয়েছে যে, হিমাগার, পাইকারি ও খুচরা বাজারে প্রাপ্ত অসংগতি দূর করতে হলে সমস্যার মূলে যেতে হবে। সে লক্ষ্যেই আজকের সচেতনতামূলক সভার আয়োজন করা হয়েছে।
অত:পর তিনি অধিদপ্তরের ঢাকা জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক জনাব আব্দুল জব্বার মন্ডলকে বিগত দিনগুলোতে আলু, পেঁয়াজ ও ডিমের মূল্যের উপর পরিচালিত অভিযানের বিষয়ে সভায় বলার জন্য নির্দেশনা প্রদান করেন। অধিদপ্তরের ঢাকা জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আব্দুল জব্বার মন্ডল জানান যে, তিনি মহাপরিচালক মহোদয়ের নির্দেশনাক্রমে কারওয়ান বাজার, শ্যামবাজার, মিরপুর শাহ আলী মার্কেটের আলুর আড়তদারকে মুন্সিগঞ্জ জেলার বিভিন্ন হিমাগার থেকে সরকারি দরে (২৬/২৭ টাকা কেজি) আলু ক্রয়ের ব্যবস্থা করে দেয়ার প্রস্তাব দিলেও সংশ্লিষ্ট আলু ব্যবসায়ীগণ কোন রকমের আগ্রহ দেখাননি। তিনি আরো বলেন, মিরপুর শাহ আলী মার্কেটের এক ব্যবসায়ী জানান যে, তারা ব্যাপারীর কাছ থেকে সারা বছর আলু ক্রয় করে থাকেন। অল্প কিছুদিন সরাসরি হিমাগার থেকে আলু ক্রয় করলে অন্য সময় বেপারীরা তাদের সহযোগিতা করবে না। এছাড়াও কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ীগণ জানান যে, তাঁরা ব্যাপারীর কাছ থেকে আলু ক্রয় করে থাকেন এবং এ বিষয়ে সমিতির সদস্যদের সাথে আলাপ করে জানাবেন। কিন্তু তারা আর সে বিষয়ে জানান নি। তিনি আরও বলেন, শ্যামবাজারের আলুর আড়তদারগণ জানান যে, তাঁদের নিজস্ব কোন পুঁজি নেই এবং তাঁরা ব্যাপারীর আলু কমিশনে বিক্রি করে থাকেন। বেপারীদের সাথে কথা বললে তারা জানান যে, তারা পূর্বে থেকে কিছু আলু ক্রয় করে হিমাগারে সংরক্ষণ করে রেখেছেন সেগুলো বিক্রি করার পর বিষয়টি ভেবে দেখবেন। এছাড়াও একজনের নামে নিবন্ধন নিয়ে একাধিক ব্যবসায়ী কর্তৃক ব্যবসা পরিচালনা, ক্রয় ভাউচার দেখাতে না পারা, মূল্য তালিকা প্রদর্শন না করার মতো বিষয়গুলোও তদারকিকালে দেখা যায় মর্মে তিনি উল্লেখ করেন।
সভায় অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (অভিযোগ) জনাব হাসানুজ্জামান গত ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখ পর্যন্ত বগুড়া, রংপুর ও নীলফামারী জেলায় আলুর হিমাগারসমূহ তদারকিকালের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন।তিনি বলেন, কৃষকের নামে হিমাগার মালিকগণ ঋণ নিয়ে থাকেন, প্রকৃত কৃষক ঋণ পান না। হিমাগার মালিকগণ ঋণের টাকা তাঁদের এজেন্টদের দিয়ে থাকেন। এজেন্টগণ কৃষকদের কাছ থেকে স্বল্পমূল্যে আলু কিনে হিমাগারে সংরক্ষণ করেন। প্রকৃত কৃষক হিমাগারে আলু সংরক্ষণ করতে পারেন না।
আলোচনায় বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশনের উপ-প্রধান জনাব মাহমুদুল হাসান অধিদপ্তরের সার্বিক কার্যক্রমের প্রশংসা করেন। তিনি সমস্যা সমাধানে নিম্ন বর্ণিত প্রস্তাব তুলে ধরেন-
১। আলু ক্রয় বিক্রয়ে ডিমান্ড অর্ডার (D.O) প্রথা বাতিল করতে হবে এবং সাপ্লাই অর্ডার (S.O) প্রথা চালু করতে হবে।
২। কৃষি ঋণে পরিবর্তন আনতে হবে যাতে প্রকৃত কৃষক ঋণ পেতে পারেন।
৩। আলু, পিঁয়াজের গ্রেড ভিত্তিক মূল্য নির্ধারণ করা যেতে পারে।
৪। প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষেত্রে ক্ষতির পরিমান নির্ধারণ করে দেওয়া যেতে পারে।
৫। দেশের সকল হিমাগারে (Cold Storage) ডাটাবেজ করতে হবে।
৬। কৃষিপণ্য বিক্রয় পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হবে।
৭। কমিশন এজেন্টদের নিবন্ধনের আওতায় আনতে হবে।
সভায় মহাপরিচালক বলেন, শ্যামবাজার, কারওয়ান বাজারের মতো পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীগণ তাদের সমিতির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন যে পাকা ভাউচার ছাড়া কোন পণ্য / পণ্যবাহী ট্রাক তাঁদের বাজারে প্রবেশ করতে পারবে না। পাইকারি ব্যবসায়ী ও সুপারশপসমূহ সরাসরি হিমাগার থেকে আলু কিনতে চাইলে অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা হবে। সমবায় সমিতির নিবন্ধন নিয়ে যারা ব্যবসা পরিচালনা করছেন তাঁদের সমিতির গঠনতন্ত্রসহ সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র যাচাই করা হবে।
তিনি আরো বলেন, যদি কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অতি মুনাফা লাভের অপচেষ্টা করা হয় তবে আলুর সরবরাহ নিশ্চিত করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে আলু আমদানির জন্য বলতে আমরা বাধ্য হবো।
পরিশেষে মহাপরিচালক সভায় উপস্থিত সকলকে অংশগ্রহণের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত মূল্য বাস্তবায়নে সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করবেন মর্মে আশাবাদ ব্যক্ত করে সভার সমাপ্তি ঘোষণা করেন।