ইটের বিকল্প পরিবেশবান্ধব কংক্রিট ব্লক

মহানগর ডেস্ক: দেশে টানা দাবদাহ, খরা আর অনাবৃষ্টিতে শুধু জনজীবনই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েনি, প্রকৃতিও অনেকটাই প্রাণহীন হয়ে পড়েছে। প্রতি বছর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করে তীব্র তাপপ্রবাহ সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। যেসব কারণে জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকি বাড়ছে তার মধ্যে অন্যতম দায়ী সনাতনী ইটভাটা।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব ইট তৈরির জন্য কৃষিজমির ওপরের অংশ থেকে মাটি কেটে নেয়া হয়। এতে কৃষিজমির ঊর্বরতা নষ্ট হয়। কাঠ ও কয়লা দিয়ে ইট পোড়ানোর সময় ভাটার চিমনি থেকে নির্গত ধোঁয়া পরিবেশদূষণের মাত্রাও বাড়িয়ে দেয়। ফলে একদিকে অক্সিজেন উৎপাদক গাছ কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে ইটের ভাটা থেকে বিষাক্ত কার্বন গ্যাস ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে। এতে মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশের।

পরিবেশ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, দেশে প্রচলিত ইটভাটার সংখ্যা প্রায় ১০ হাজারের মতো। এসব ভাটায় বছরে প্রায় ২২ দশমিক ৭১ বিলিয়ন পোড়া ইট হয়। এ জন্য ২৫ বিলিয়ন কিউবিক ফুট টপ সয়েল পোড়াতে সাড়ে ৩ মিলিয়ন টন কয়লা ও ১ দশমিক ৯ মিলিয়ন টন জ্বালানি কাঠ পোড়ানো হয়। যা থেকে মারাত্মক ক্ষতিকর ৯ দশমিক ৮ মিলিয়ন টন গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন হয়।

২০১৯ সালের ২৬ নভেম্বর বৈশ্বিক বায়ুমান পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান এয়ারভিজুয়ালের প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, পৃথিবীর ৯১টি বড় শহরের মধ্যে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর মানদণ্ডে ঢাকা শহরের অবস্থান দ্বিতীয়। এ প্রেক্ষাপটেই ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মুন্সিগঞ্জ ও মানিকগঞ্জ জেলার সব অবৈধ ইটভাটা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট।

এদিকে প্রচলিত ইটের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে ২০২৫ সালের মধ্যে সনাতন লাল ইটের ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে সরকারি উন্নয়নকাজে ব্লক ইট ব্যবহারের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০১৯ সালে ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করা হয়। ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ (সংশোধিত ২০১৯) এর ধারা ৫(৩ক) এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে মাটির ব্যবহার পর্যায়ক্রমে হ্রাস করার উদ্দেশ্যে সকল সরকারি নির্মাণ, মেরামত ও সংস্কার কাজে ভবনের দেয়াল ও সীমানা প্রাচীর, হেরিং বোন বন্ড রাস্তা এবং গ্রাম সড়ক টাইপ-বি এর ক্ষেত্রে ইটের বিকল্প হিসেবে ব্লক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের মধ্যে শতভাগ ব্লক ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে ২০১৯ সালের ২৪ নভেম্বর প্রজ্ঞাপন জারি করে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়।

ইটের বিকল্প পরিবেশবান্ধব কংক্রিট ব্লক তৈরি হয় স্বয়ংক্রিয় মেশিনে। ব্লক তৈরিতে ব্যবহার হয় সিমেন্ট, কুচি-পাথর, সিলেটের বালু, সাধারণ বালু ও স্টোন ডাস্ট যা মাটি ছাড়াই এবং না পুড়িয়ে তৈরি করা হয়। পরিবেশ ও জলবায়ুর ও কোনো ক্ষতি হয় না। কংক্রিট ব্লক ব্যবহারের সুফল অনেক। সবচেয়ে বড় দিক হচ্ছে সনাতন লাল ইটের চেয়ে এর নির্মাণ খরচ তুলনামূলক কম।

কংক্রিট ব্লকের দেয়ালের গাঁথুনিতে সিমেন্ট-বালু কম লাগে। এ ছাড়া এটি ব্যবহারে ভবনের ওজন কম হয়। ভবন নির্মাণের সময়ও কম লাগে। কংক্রিটের হওয়ায় এটি মজবুত হয় এবং নির্মাণের স্থায়িত্ব বাড়ে। সনাতন লাল ইটের মতো এতে নোনা ধরে কম। শব্দ-দূষণ ও তাপ পরিবহনের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে ৪০ শতাংশ কম থাকে এতে। এর আরেকটি ভালো দিক হলো কংক্রিট ব্লক দিয়ে তৈরি হলে ঘরের ইন্টেরিয়র ডিজাইনেও অনেক সুবিধা পাওয়া যায়। যেমন ব্লকের তৈরি দেওয়ালে শুধু রং দিয়েই ফিনিশিং দেয়া যায়। এতে খরচও কমে। বাইরের প্রাচীরে ব্লক গাঁথুনির মাধ্যমে বৈচিত্র্যও আনা যায়। ইটের বিকল্প পরিবেশবান্ধব, সাশ্রয়ী ও তুলনামূলক ভূমিকম্পসহনীয় হওয়ায় দেশের নির্মাণ খাতে বাড়ছে ব্লকের চাহিদা। ফলে, পরিবেশবান্ধব ইকো–ব্লকের নানান সুবিধা ও প্রচলিত ইটভাটা থেকে সৃষ্ট পরিবেশের ক্ষতি রোধের দায়বদ্ধতা থেকে মানুষ ক্রমে পরিবেশবান্ধব ঘর তৈরিতে আগ্রহী হয়ে উঠছে।

পরিবেশ ও জলবায়ুর কথা বিবেচনা করে ইটের বিকল্প ও ব্যয় সাশ্রয়ী নির্মাণ উপকরণ দিয়ে ইটের বিকল্প পরিবেশবান্ধব কংক্রিট ব্লক নিয়ে কাজ করছেন তরুণ উদ্যোক্তা সৌরভ ইয়াকুব হোসেন। সৌরভ ইয়াকুব পড়াশোনা করেছেন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। পড়াশোনা শেষ করে ইটের বিকল্প পরিবেশবান্ধব কংক্রিট ব্লক তৈরিতে মনোযোগ দিয়েছেন তিনি। ইকো ব্লক ব্রিকস তৈরি করতে ঢাকার অদূরে সাভার-হেমায়েতপুরে হোজায়ফা ইকো ব্রিকস নামে একটি ব্রিকস ফ্যাক্টরি করেছেন। আধুনিক স্বয়ংক্রিয় মেশিনে প্রতিদিন ১৫-২০ হাজার ব্লক তৈরি হচ্ছে ওই কারখানায়। সৌরভ প্রথমে নিজস্ব ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান স্টিল স্ট্রাকচারাল ওয়ার্কসের জন্য এই ইকো-ব্রিকস তৈরি শুরু করলেও পরে বাণিজ্যিকভাবেও বিক্রি শুরু করেছেন।

সৌরভ ইয়াকুব হোসেন বলেন, সমাজের স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য স্বল্প খরচে টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব বাড়ি নির্মাণের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি নিরসনের লক্ষ্যে পরিবেশবান্ধব ইটের বহুল ব্যবহার একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হতে পারে। ক্রমবর্ধমান চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা নিয়মিত ইকো-ব্রিকসের উৎপাদন বাড়াচ্ছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *